হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্ব ১- মুসলিম উম্মাহকে প্রকৃত ধর্ম তথা সত্যিকারের মোহাম্মদী ইসলামের আলোর বন্যায় আলোকিত করা ছিল যাঁদের অক্লান্ত সাধনা এবং যাঁরা নিজ জীবনকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করে মানুষের জন্য রেখে গেছেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কল্যাণের অফুরন্ত ফল্গুধারা, আর মানব-সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছিল যাঁদের গৌরবোজ্জ্বল শিক্ষার মূল-ভিত্তি ইমাম হাসান আসকারি (আ:) ছিলেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়।
এ মহান ইমামের পবিত্র ও আলোকময় জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক এখানে তুলে ধরা হলো:
২৩২ হিজরীর ৮ই রবিউস সানি ইসলামের ইতিহাসের একটি বিশেষ স্মরণীয় ও মহাখুশির দিন। কারণ, এ দিনে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত বা তাঁর নিষ্পাপ বংশধারার অন্যতম সদস্য, মুসলিম উম্মাহর অন্যতম পথ-প্রদর্শক হযরত ইমাম হাসান আসকারি (আ.)। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন পবিত্র মদীনা শহরে। তাঁর পিতাও ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হাদী (আ.)। মা হুদাইসা ছিলেন ন্যায়পরায়ন ও অনেক গুণে বিভূষিত মহিয়সী নারী।
বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের কোনো ইমামই অবাধে বা বিনা বাধায় ধর্ম প্রচার করতে পারেননি। এই মহান ইমামও শ্বাসরূদ্ধকর ও কঠিন পরিবেশে জীবন-যাপন করতেন এবং অন্য ইমামদের মতই নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়েছিলেন। আব্বাসীয় শাসকরা তাঁর ওপর সদা-সতর্ক দৃষ্টি রাখত এবং তাকে একাধিকবার বন্দিও করে। এমনকি বন্দীদশা থেকে মুক্ত অবস্থায়ও ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করত আব্বাসীয় শাসকরা। তার ছয় বছরের ইমামতের যুগে মোতায, মোহতাদী ও মোতামেদ ছিল আব্বাসীয় খলিফা।
আব্বাসীয় শাসকরা মনে করত জনগণের মাঝে নবীজীর আহলে বাইতের বিশেষ মর্যাদা ও অবস্থান তাদের ক্ষমতার জন্য হুমকি। অন্য যে কারণে ইমাম হাসান আসকারি (আ.)কে তারা হুমকি মনে করতেন তা হল অনেক হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী এ ইমামের সন্তানই হলেন বিশ্বের সেই ত্রাণকর্তা যিনি সব ধরণের জুলুম নির্যাতনের মূল উপড়ে ফেলে তাগুতি শক্তিকে পরাভূত করবেন এবং বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র চারিত্রিক গুণ ও সাধনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বন্ধু ও শত্রু মহলে। শত্রুরাও তাঁর মহত্ত ও শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। সে যুগের আহলে বাইত(আ.)-বিদ্বেষী হিসেবে খ্যাত কোম শহরের রাজস্ব কালেক্টর আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে খাকান বলেছেন, "ইমাম হাসান আসকারি (আ:) আপামর জনসাধারণের মধ্যে সম্মানিত ছিলেন। আমি তাঁর এমন কোনো বন্ধু বা শত্রু দেখিনি যারা ইমামের অনুগ্রহ ও বদান্যতার কথা স্বীকার করেননি। বনি হাশেমের যার কাছেই ইমাম সম্পর্কে জানতে চেয়েছি সবাই তার মহত্ত্ব, সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার কথা বলেছেন।"
আব্বাসীয় শাসক মোহতাদি ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-কে কারাগারে বন্দী করে তাঁকে কঠিন শাস্তি দিতে কারাধ্যক্ষকে নির্দেশ দেয়। কারাধ্যক্ষ এ জন্য দু'জন জল্লাদ নিয়োগ করে । কিন্তু তারা ইমামের অনুপম চরিত্র ও এবাদত-বন্দেগী তথা দিন রাতের নামাজ-রোজা দেখে নিজেরাই বদলে যায় ও নামাজী হয়ে যায়। কারাধ্যক্ষ তাদের তিরস্কার করলে দুই জল্লাদ জবাবে বলে, "আমরা কি করব, যে ব্যক্তি সারা দিন রোজা রেখে সারা রাত নামাজে মগ্ন থাকেন এবং এবাদত ছাড়া অন্য কিছুই করেন না? আমরা যখনই তাঁর দিকে দৃষ্টি দিতাম নিজেদের অজান্তেই কাঁপতে থাকতাম এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতাম.....।"
বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রদর্শিত শিক্ষার সংরক্ষণ, প্রসার-প্রচার ও বিকৃতি রোধ এবং মুসলমানদের জ্ঞানগত উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়ন ছিল প্রত্যেক পবিত্র ইমামের কিছু প্রধান কর্মসূচী। বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হাসান আসকারি (আ.)ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। এই পবিত্র ইমামরা মুসলিম সমাজ পরিচালনার সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ও প্রকৃত আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন বলে ভীত-সন্ত্রস্ত তাগুতি শাসকরা তাদেরকে নানা অজুহাতে হয় বন্দী অথবা গৃহবন্দী অবস্থায় রেখেছেন।
যা হোক ইমাম হাসান আসকারি (আ:) তাঁর মহান পুত্র তথা প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.)'র অন্তর্ধানের পরিবেশ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে জনগণকে এ বিষয়টি বোঝানো ছিল খুবই কঠিন কাজ। হযরত ঈসা (আ:) যদি শত শত বছর ধরে অদৃশ্য থাকতে পারেন এবং অদৃশ্য থাকতে পারেন হযরত খিজির (আ:) তাহলে মানব জাতির প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তাও যে একইভাবে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত অদৃশ্য থাকতে পারেন তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চাননি বা এখনও চান না।
বিজ্ঞ আলেমদের অনেকেই এটা মনে করেন যে, জনগণ বা মানব জাতি যদি শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের পরিবেশ সৃষ্টি না করেন তাহলে তার আবির্ভাব বিলম্বিত হতেই থাকবে। তাদের মতে এ জন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, "আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যদি তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন না করে।" ...(চলবে)...